,

স্মৃতি অমলিন

।। মাসুদা খালেদ ।।

১৯৭১ সাল। ডিসেম্বর মাস। সংকটময় সময় পার করছি আমরা। পাক বাহিনী স্মশানে পরিণত করেছে এ দেশকে। তবুও প্রাণপন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে বাংগালীরা। না, প্রাণ দেবে তবু পিছু হটবে না। কিছুতেই না। দেশকে স্বাধীন করেই ছাড়বে শান্তি প্রিয় জাতি হিসাবে আমাদের খ্যাতি থাকলেও আমাদের তখন রুদ্র মূর্তি। আমি তখন ম্যাট্রিকের ছাত্রী। বীণাপাণি সরকারি স্কুলে পড়ি। যুদ্ধের ভয়বহতা সম্পর্কে বইয়ে পড়েছি। কিন্তু সেটা শুধুই পড়ার জন্য পড়া। হৃদয়াঙ্গম করিনি কখনও। কিন্তু এখন করছি। প্রতি মূহুর্তে-প্রতি পলে। গোপালগঞ্জ ছোট শহর। তখন আরও ছোট ছিল। খবরের কাগজ আর রেডিও ছাড়া আর কোন মিডিয়া ছিল না। যোগাযোগ ব্যবস্থা এতই খারাপ ছিল যে প্রতিদিনের কাগজ প্রতিদিন আসত না। তাই আমাদের ভরসা ছিল একটা ফিলিপ্স রেডিও। লুকিয়ে লুকিয়ে আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনতাম। সবার বাড়ীতে রেডিও ছিল না। আশে পাশে অনেকেই আমাদের বাসায় আসত রেডিও শুনতে। রেডিওর খবর শুনতে সবাই আগ্রহ নিয়ে বসে যেত। রেডিও ঘিরে ছোট খাট আসর বসত। উৎকণ্ঠা নিয়ে সবাই খবর শুনত। এভাবে খবর শোনাটাও ছিল প্রচন্ড ভয়ের। শত্রুর তো অভাব নাই। কে কখন দেখে ফেলে। কত আত্মীয় স্বজন, পরিচিত মানুষ যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। এদের কারোর খবরই প্রায় জানিনা। হয়ত কেউ মারা গেছে। কেউ বেঁচে আছে। হয়ত কেউ তখনও প্রাণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে।

আমাদের তখন দিন রাত কোন রকম কাটে। স্কুল, কলেজ বন্ধ। বাজার ঘাটও বন্ধ- কিছু পাওয়া যায় না। আব্বা আমাদের গ্রামে রেখে আসলেন। অপরিচিত পরিবেশ, অন্যের বাড়ীতে থাকতে লাগলাম আমরা। কিন্তু আব্বা গ্রামে থাকাটাও নিরাপদ মনে করলেন না। তাই আমরা ফিরে আসলাম শহরের বাড়ীতে। শহরও তখন ফাঁকা। পাক বাহিনীর অত্যাচারের কারণে যে যেভাবে পেরেছে সেভাবেই পালিয়েছে।

ডিসেম্বরে যুদ্ধের ধরন পাল্টে গেল। আমরা সুখবর পাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। রেডিও শুনি কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু বুঝি না। আব্বার মুখের হাসি দেখে কিছুটা অনুমান করি যুদ্ধে হয়ত আমরা জিতে যাচ্ছি। আর ভয় নাই, এমন একটা ভাব ধারণা মনের ভিতর বাসা বেঁধেছে। একটা একটা করে দিন যাচ্ছে। আমরা প্রহর গুণছি। আমাদের বাসাটা স্টেডিয়ামের উল্টো দিকে। একদিন দেখলাম স্টেডেয়ামের মাঠ মানুষে মানুষে ভরে গেছে। সবার মুখে হাসি- অনেকের হাতে অস্ত্র। বুঝলাম আমরা স্বাধীন হয়েছি। পনরই ডিসেম্বর আব্বা আমাদের বললেন একটা পতাকা বানাতে। কিন্তু পতাকার মাঝখানে থাকবে বাংলাদেশের ম্যাপ। কাজটা অনেক কঠিন। আব্বার সাহায্যে কাপড়ে ম্যাপটা আঁকলাম। এবার সেলাইয়ের পালা। কাপড়ের উপর ম্যাপটা সেলাই করা ছিল আরও কষ্টের। কারেন্ট নাই সারা শহরে। হ্যারিকেনেই কাজ চলছে। আমি আর আমার সেজো আপা ‘রাশিদা কামাল’ মেশিন নিয়ে বসলাম। আব্বা, মা অন্য ভাই বোনরাও পাশে ছিল। তবে ওরা আরও ছোট ছিল। আমি সেলাই করি আর আমার সেজো আপা হ্যারিকেন উঁচু করে ধরেন। আবার সেজো আপা কিছুটা সেলাই করেন আমি হ্যারিকেন ধরি। কি যে কষ্ট করে পতাকাটা সেলাই করলাম আজও সে কথা স্মৃতিতে অম্লান। এভাবে পতাকা শেষ করলাম। তারপর ধরলাম সবার সামনে। আমি জানি সেলাইটা ভাল হয়নি। কিন্তু সে কথাটা তখন মনে পড়ল না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে রইলাম লাল সবুজ পতাকাটার দিকে। আব্বার দৃষ্টিতে তখন ঘোর লাগা মুগ্ধতা। উনি পতাকাটা দেখছেন। আমাদের সবার মুখে বিজয়ের হাসি, গৌরবের আনন্দ। আমরা পেরেছি। এবার পতাকাটা টানানোর পালা। আব্বা করমআলী ভাইকে ডাকলেন। একটা বাঁশের মাথায় বেঁধে দেওয়া হলো পতাকাটাকে। আমরা সবাই মিলে স্বাধীন দেশের স্বাধীন পতাকা ওড়ালাম। পতপত করে উড়তে লাগলো পতাকাটা। কি অভূতপূর্ব দৃশ্য। ভোরবেলা স্টেডিয়ামের মানুষগুলো দেখল স্বাধীন দেশের স্বাধীন লাল সবুজের পতাকাটা উড়ছে সীমাহীন গৌরবে। এর নীচে দাড়িয়ে আছি আমরা। স্টেডিয়াম মাঠ থেকে অনকেই আসল আমাদের কাছে। পতাকার নিচে সমবেত হয়ে আমরা ধন্য হলাম। অনুভব করলাম লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতার মূল্য। পতাকার পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশের ম্যাপের বদলে এসেছে লাল বৃত্ত। সেই লাল বৃত্তের দিকে তাকিয়ে আমি শুনতে পাই বঙ্গবন্ধুর বজ্র কণ্ঠ “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম”।

বয়সের ভারে আমি নুব্জ নই। তবুও জীবন সায়াহ্নে এসে পৌঁছেছি। একাত্তুরে নিজের হাতে সেলাই করা পতাকা ওড়াতে গিয়ে যে আনন্দ পেয়েছি তা আজও অম্লান। একটুও ম্লান হয়ে যায়নি। বরং বেড়েছে অনেক গুন। কখনও কখনও পতাকার লাল বৃত্তের দিকে তাকিয়ে আমার চোখের পাতা ভিজে ওঠে- ব্যাথায়, আনন্দে, গর্বে। ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া এ পতাকা আমার বড় প্রিয়। বড় বেশী আদরের।

লেখক-পরিচিতি-

সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা

এই বিভাগের আরও খবর